আইএলও রিপোর্ট ২০১৫ অনুযায়ী, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) দেশগুলোর মধ্যে কাতার একটি অন্যতম দেশ যেখানে বড় ধরনের নিমার্ণকাজ চলছে। এজন্য এখানে স্বল্প-দক্ষ শ্রমিকদের অনেক চাহিদা রয়েছে। ৬০% এরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক যারা কাতারে কাজ করে তারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারেনি।

অন্যান্য জিসিসি অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মত কাতারের একটি প্রধান খাত হলো অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগ। আইন থাকা সত্ত্বেও অভিবাসীদের নিয়োগ খরচ প্রদান এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত নিয়োগ খরচ অন্যান্য অবৈধ কাজের সাথে শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণের সুযোগ সৃষ্টি করে।

১৯৯০ এবং ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে, কাতার ও অন্যান্য জিসিসি দেশগুলোতে বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিক আরবের অন্য দেশ থেকে আসতে দেখা যেত। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এশিয়ার শ্রমিকগণ বেশি অনুগত এবং তাদের খরচ তুলনামূলক কম। এছাড়া তাদের সহজেই পরিচালনা করা যায়। 

এশিয়ার শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ধারণা কাজ করে যে, তারা কোনো নির্ভরশীল (পরিবার) ছাড়াই এ ধরনের অভিবাসন করতে পারে। পক্ষান্তরে, আরবের অন্যান্য শ্রমিকরা পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে আসে। এশিয়ার শ্রমিকদের বিষয়ে এই ধারণাটি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চাকরিদাতা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের জন্য ফিলিপাইনের শ্রমিকদের বেশি পছন্দ করে কারণ তারা ইংরেজিতে ভালো দক্ষ । এছাড়াও ফিলিপাইনের প্রশিক্ষণ সংস্থাগুলোর ভালো সুনাম রয়েছে। একইভাবে, পাকিস্তানিরা ভালো গাড়িচালক এবং ভারতীয়রা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ইথিওপিয়া, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ানরা কম বেতনের বিনিময়ে কাজ করে থাকে।

অন্যান্য জিসিসি দেশগুলোর মতই কাতারে নিয়োগ প্রক্রিয়া  কাফালা (স্পন্সরশিপ) পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। যেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের অনুমোদিত স্পন্সরের প্রয়োজন হয়। সরকারিভাবে কাতার শ্রমিকদের ভ্রমণের কাগজপত্র বাজেয়াপ্তকরণ নিষিদ্ধ করেছে; যদিও কিছু স্পন্সর এখনও অভিবাসীদের পাসপোর্ট জমা নিয়ে থাকে। ২০১৩ এর আইএলও রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯০% নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত (কেড়ে নেয়া) করা হয়েছে। এটি শ্রমিকদের চলাচলের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান করে। এবং এর মাধ্যমে বিদেশি শ্রমিকদের উপর কফিল বা মালিকগণ অন্যায়ভাবে শাসন করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও শোষণ ছাড়াও এই কাফালা পদ্ধতি স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষত নারী শ্রমিকদের জন্য। দক্ষ শ্রমিক বিশেষত যারা পশ্চিমাদেশ থেকে আসে তাদের ঝুঁকি কিছুটা কম।

কাফালা পদ্ধতিটি অনেক বেসরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা সমালোচিত। কাতার ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ রিপোর্ট থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের অবস্থা জানা যায়। বিশেষভাবে ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ এর মত বড় পরিকাঠামোগত জায়গায় কাজ করে এমন শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। এই ফাউন্ডেশনের ২০১৪ সালের রিপোর্টে কাফালা পদ্ধতির কিছু সমস্যা উল্লেখ করা হয়। প্রথমত, দ্বি-পাক্ষিক শ্রমচুক্তি (উপরে উল্লেখিত দেশসমূহের সাথে) থাকা সত্ত্বেও এগুলোতে শুধু শ্রমিক সরবরাহ বিষয়ে বলা হয়েছে। একইসাথে এখানে নৈতিক নিয়োগের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগের জন্য অর্থ প্রদান করতে হয় যা প্রায় ৫,০০০ ইউএস ডলার (আমেরিকান ডলার) পর্যন্ত হয়ে থাকে। তৃতীয়ত, কোম্পানি সরাসরি শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে প্রায়ই ঠিকাদারকে প্রদান করে থাকে, যার ফলে নিয়োগ ও পারিশ্রমিকের বিষয়টি আরও অস্পষ্ট হয়ে থাকে। সর্বশেষ, যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হয় তা শ্রমিকদের দেওয়া হয় না অথবা মূল চুক্তিপত্রের পরিবর্তে নকল চুক্তিপত্র দেওয়া হয়। যেখানে পূর্বের তুলনায় কম বেতন ও খারাপ পরিবেশের কথা উল্লেখ থাকে। এই রিপোর্টটিতে আইন যথাযথভাবে না মানা, অবৈধভাবে ভিসা বাণিজ্য ইত্যাদির কথা উল্লেখ রয়েছে।

যা-ই হোক, কাতার সরকার এই কাফালা পদ্ধতি বিলোপ করার জন্য একটি নতুন নীতিমালা ও প্রতিশ্রুতিপত্র তৈরি করেছে যেখানে নিচের ছয়টি ধাপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।

১ . শ্রমিকদের নিয়োগ চুক্তিপত্র পরিবর্তন, কাতারে আসার পর অল্প বেতনের শ্রমিকের চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলা বা অন্য চাকরিতে পাঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি রোধের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়োগ চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে।

২ . নিয়োগকর্তা শ্রমিকদের দেশ ত্যাগ করায় বাধা দিতে পারবে না।

৩ . সব শ্রমিকদের জন্য একটি ন্যূনতম বেতন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে যা বর্ণভিত্তিক বেতন পদ্ধতি বন্ধ করবে।

৪ . কাতার সরকার কর্তৃক সরাসরি শ্রমিক শনাক্তকরণ কাগজপত্র প্রদান করবে এবং শ্রমিকদের আইডি কার্ডের জন্য নিয়োগকর্তার উপর নির্ভর করতে হবে না। আইডি কার্ড ব্যতীত শ্রমিকরা স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।

৫ . প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের বাছাইকৃত প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত শ্রমিক সংগঠন তৈরি করা হবে।

৬ . একটি অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি তৈরি করা হবে যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এই কমিটি যেকোনো অভিযোগ দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করবে।

এই দেশের শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানতে এখানে আইটিইউসি গ্লোবাল রাইটস ইনডেক্স ভিত্তিক তথ্য দেখুন।